জুডিশিয়াল রিভিউ বা বিচারিক পর্যালোচনা শব্দটি বাংলাদেশের আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নাই। তবে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগে সরকারী কর্তৃপক্ষের ক্রিয়াকলাপ পর্যালোচনা করার জন্য, বা নিম্ন আদালতে কার্যক্রম স্থগিত করার জন্য রিট আবেদন করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
নিম্নে জুডিশিয়াল রিভিউ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
জুডিশিয়াল রিভিউ বলতে কি বুঝায়?
বাংলাদেশে সাংবিধানিক প্রাধন্য স্বীকৃত। সুপ্রীম কোর্ট এই প্রাধন্য নিশ্চিত করার জন্য এবং সংরক্ষণ করার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। এই ক্ষমতাবলে সুপ্রীম কোর্ট আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, ও অন্যান্য কর্তৃকপক্ষের কার্যাবলী পর্যালোচনা করতে পারেন এবং সংবিধান বা অন্য কোন প্রচলিত আইন বা স্বাভাবিক ন্যায়নীতির পরিপন্থী প্রতীয়মান হলে তা বাতিল ঘোষণা করতে পারেন।
তাই প্রশাসনিক কার্যক্রমের উপর বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ বলতে এমন এক পদ্ধতি বুঝায় যার মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্ট প্রশাসনের বা নির্বাহী বিভাগের গৃহীত কার্যক্রমের সাংবিধাননিক বৈধতা নির্ধারণ করে থাকেন। সুপ্রীম কোর্ট তার তত্ত্বাবধায়নের এখতিয়ার প্রয়োগ করে প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। আইনের শাসন এবং সাংবিধানিক প্রাধন্য নিশ্চিত করতে প্রকৃতপক্ষে এরূপ বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়।
দেওয়ানী কার্যবিধির ৯ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আইনে নিষিদ্ধ না হলে দেওয়ানী প্রকৃতির সকল প্রকারের মামলার বিচার দেওয়ানী আদালতগুলি করতে পারবে এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের বিধান অনুযায়ী প্রতিকার দিবে। এই ক্ষমতাবলে আদালত প্রশাসনিক সকল কার্যক্রমই পর্যালোচনা করতে পারে।
উচ্চ আদালতের বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত। সংবিধানের ১০২ ও ৭ অনুচ্ছেদের এটাই হচ্ছে মর্মকথা। সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য এবং আনোয়ার হোসেন চৌধুরী [১৯৮৯ বি. এল. ডি. (স্পেশাল) ১] সিদ্ধান্তে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, উচ্চ আদালতের এরূপ কর্তৃত্ব সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমেও সংকুচিত বা বাতিল করা যাবে না।
বিচারিক পর্যালোচনা (Judicial Review) ক্ষমতাবলে সুপ্রীম কোর্ট শুধুমাত্র প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে না, সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করে এরূপ আইন প্রণয়নও বাতিল ও অকার্যকর ঘোষণা করতে পারে। জুডিশিয়াল রিভিউ এর মাধ্যমে যে কোন কার্যক্রমের বৈধতা ও সাংবিধানিকতা নির্ধারণ করা হয়।
জুডিশিয়াল রিভিউ এর ভিত্তি দু’টি। যথাঃ
- Ultra vires বা ক্ষমতা বহির্ভূত মতবাদ ; এবং
- Natural Justice বা স্বাভাবিক ন্যায়বিচার নীতি।
আলট্রা ভাইরেস বা ক্ষমতা বহির্ভূত মতবাদ এবং ন্যাচারাল জাস্টিস বা স্বাভাবিক ন্যায়বিচার মতবাদটি ব্রিটিশ কমন ল’ উদ্ভূত এবং উত্তরাধিকার সূত্রে এগুলি বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থায় স্থান করে নিয়েছে।
Ultra vires বা ক্ষমতা বহির্ভূত মতবাদ
সংবিধান হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং সংবিধানের অভিভাবক হচ্ছে সুপ্রীম কোর্ট। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক, বিচারিক, আইন প্রণয়নসহ সকল কার্যক্রম এই সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। কাজেই কোন কার্যক্রম সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা যাচাই করে দেখার অধিকার সুপ্রীম কোর্টের রয়েছে। জুডিশিয়াল রিভিউ এর আওতায় সুপ্রীম কোর্ট কোন কার্যক্রমের বৈধতা পরীক্ষা করে থাকে। সংবিধিানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে তা আলট্রা ভাইরেস ঘোষণা করে অকার্যকর করতে পারে।
Natural Justice বা স্বাভাবিক ন্যায়বিচার নীতি
ন্যাচারাল জাস্টিসের মূলকথা হচ্ছে সৎ ও নিরপেক্ষ পদ্ধতি অনুসরণ। এর ব্যতিক্রম ঘটলে জুডিশিয়াল রিভিউ এর আওতায় বিবেচনা করে আদালত তা অকার্যকর ঘোষণা করতে পারে। স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের নীতি প্রয়োগ করেই সমগ্র বিশ্বে আইন ও সংবিধান সমৃদ্ধশালী করা হয়েছে। স্বেচ্ছাচারিতা রোধে স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হলে তা পদ্ধতিগত আলট্রা ভাইরেস হিসেবে গণ্য করা যায়। এটা দু’শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। যথাঃ
- প্রথমতঃ কোন ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে শাস্তি দেয়া যায় না।
- দ্বিতীয়তঃ কোন ব্যক্তি সে বিচার কার্য সম্পন্ন করতে পারে যেখানে তার নিজ স্বার্থ জড়িত রয়েছে।
তাই দেখা যায় যে, স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের নীতি ও আলট্রা ভাইরেস মতবাদ প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের উচ্চ আদালত জুডিশিয়াল রিভিউ কার্যক্রম গ্রহণ করে প্রত্যেকটি পদক্ষেপের বৈধতা নিরুপণ করে থাকে।