সাধারণভাবে আন্তর্জাতিক আইন বলতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমন্বয়ে সৃষ্ট আইন, যা এক রাষ্ট্র বা জাতির সাথে অন্য রাষ্ট বা জাতির সম্পর্ক নির্ধারণ করে।আন্তর্জাতিক আইন কোন একক রাষ্ট্রের সৃষ্টি নয়। এ আইন বিভিন্ন রাষ্ট্রের ঐকমত্য ও অংশগ্রহনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং তা প্রত্যেক রাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থ,সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও অন্য রাষ্ট্রের সাথে সুস্পকৃ বজায়রাখার জন্য সৃষ্ট।প্রত্যেক রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন শ্রদ্ধার সাথে মেনে চলতে দায়বদ্ধ।প্রধানত দু ইবা ততোধির রাষ্ট্রের সার্থে সৃষ্ট সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে এ আইনের সৃষ্টি। চুক্তিভ’ক্ত রাষ্ট্র গুলো এ আইন মেনে চলতে বাধ্য। তবে অনেক ক্ষেত্রে এ ব্যতিক্রমও দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় আইন থেকে আন্তর্জাতিক আইন চারিত্রিক দিক থেকে পৃথক; এ আইন জনগনের জন্য নয়,রাষ্ট্রের জন্যঘোষিত। আন্তজাতিৃ আইন নিশ্চিত করার জন্য বেশ কয়েকটি সংস্থা গঠিত হয়েছে এবং কয়েকটি ঘোষনা কনভেনশন ঘোষিত হয়েছে।
বিশেষ অবস্থিত রাষ্ট্রসমূহের পরস্পর সম্পর্ক স্থাপন ও নিয়ন্ত্রন বিধিকেই আন্তজার্তিক আইন বলে।
১৭৮০ সালে বিশিষ্ট আইনজীবি জেরেনী বেনথাম আন্তজার্তিক আইন শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। পূর্বে ইহাকে জাতিসমূহের আইন বলা হত।
অধ্যাপক ওপেন হাম এর মতে,
আন্তজার্তিক আইন বলতে সে সকল প্রচলিত প্রথা বা রীতিনীতি কে বোঝায় যা বিভিন্ন রাষ্ট্র তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও আদান প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই পালনীয় এবং কার্য়করী বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
আন্তজার্তিক আইন বলতে সকল স্বাধীন জাতি সমূহের মধ্যে বলবৎ যোগ্য নীতি সমূহকে বোঝানো হয়েছে।
- আন্তজার্তিক আইনের জনক-হুগো গ্রোসিয়াস
আন্তর্জাতিক আইনের উৎস:
উৎস বলতে উৎপত্তি স্থল বুঝায়। তাই আন্তজার্তিক আইনের উৎস বলতে কিভাবে এ আইনের সৃষ্টি হয়েছে তা বুঝায়। আন্তজার্তিক আইন প্রণয়নের জন্য কোন সংসদ নেই বা এটি কোন সাবৃভৌম কর্তৃপক্ষের প্রণীত আইন নয়। এর কোন নির্দিষ্ট উৎস নেই।
ড: লরেন্সের মতে,
আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে আইন হিসেবে যখন যাত্রা শুরু করে তাকে উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করলে রাষ্ট্রসমূহের সম্মতি হচ্ছে আন্তজার্তিক আইনের একমাত্র উৎস। এরুপ সম্মতি ব্যক্ত বা অব্যক্ত হতে পারে। সন্ধি-চুক্তি বা আন্তজার্তিক দলিলপত্র যেগুলি সন্ধির মত গুরুত্ব পেয়ে থাকে সেগুলি হচ্ছে ব্যক্তি সম্মিতির প্রতিফলন।
প্রথা বা আন্তজার্তিক রীতিনীতি যেগুলি আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে লেনদেনে ব্যাপারে রাষ্ট্রসমূহ যুগ যুগ ধরে মেনে আসছে তা হচ্ছে অব্যক্ত সম্মতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী আন্তজার্তিক আদালত স্থাপিত হয়েছে সে সংবিধির ৩৮(১) অনুচ্ছেদে নিম্নোক্তগুলিকে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস বলা হয়েছে।
- ১) আন্তজার্র্তিক কনভেনশন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিধিসমূহ
- ২) আন্তজার্তিক প্রথা।
- ৩) সভ্য জাতি কর্তৃক স্বীকৃত আইনের সাধারণ নীতিসমূহ।
- ৪) ৫৯ নং অনুচ্ছেদ সাপেক্ষে বিচারিক সিন্ধান্ত
প্রচলিত আইনে নি¤েœাক্তগুলো পরিলক্ষিত হয়-
- ১) প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতি:আন্তজার্তিক আইনমূলত প্রথা ভিত্তিক আইন। প্রথাকেই আন্তজার্তিক আইনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে গন্য করা হয়।
- ২) সন্ধি বা চুক্তি: পরস্পরের মধ্যে অধিকার ও দায় দায়িত্ব সৃষ্টির জন্য দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পদিত চুক্তিই হচ্ছে সন্ধি। সন্ধি-চুক্তিকে আন্তজার্তিক আইনের বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
- ৩) বিচার বিভাগীয় সিন্ধান্ত:বিচার বিভাগীয় সিন্ধান্ত সমূহকেও আন্তজার্তিক আইনের অন্যতম উৎস হিসাবে গণ্য করা হয়।
- ৪) আইনের সাধারণ নীতি সমূহ: আইনের সাধারণ নীতিসমূহকে আন্তজার্তিক আইনের সহায়ক উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়।
- ৫) আইন শাস্ত্রের উপর রচিত পুস্তকাদি: সমগ্র বিশ্বের খ্যাতিমান ভাষ্যকার ও আইনবিদগণের রচিত পুস্তাকাদিও আন্তজার্তিক আইনের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন- যুদ্ধ বনাম শান্তি
- ৬) রাষ্ট্রীয় দলিলাদি:বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে আন্তজার্তিক সমস্যাবলী ও পারস্পরিক লেনদেনের প্রশ্নে যে সকল কাগজপত্র ও দলিল পত্রের মাধ্যমে আলাপ আলোচনা হয় এবং সুপারিশ সমুহ লিপিবদ্ধ করা হয়, সেগুলোও আন্তজার্তিক আইনের অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।
- ৭) রোমান আইন: সর্বোপরি আন্তজার্তিক আইনের উৎস হিসেবে রোমান আইনের অবদান অপরিসীম। আন্তজার্তিক আইনের মূল কাঠামোর সাথে রোমান আইনের যথেষ্ট সামঞ্জস্য বিদ্যমান। আন্তজার্তিক আইনের উন্নতি ও ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে রোমান আইনের অবদান কালের নিরিক্ষে সমূজ্জ্বল থাকবে।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষপটে আমরা বলতে পারি যে, একটি নয়-বরং বহুবিদ উৎস্যের সমন্বয়ে আন্তজার্তিক আইন বিকাশ লাভ করেছে।
আন্তজার্তিক আইনে উৎস হিসাবে উদাহরণ সহ আইনের সাধারণ নীতিসমূহ ব্যাখ্যা:
আন্তজার্তিক আদালতের গঠন তন্ত্রে লিপিবদ্ধ আছে যে, জটিল সমস্যার সমাধান ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তজার্তিক আদালত আইনের সাধারণ নীতিসমুহ অনুসরণ ও প্রয়োগ করতে পারেন (সংবিধির ৩৮(১/গ) অনুচ্ছেদে) ।
এই সংবিধির বক্তব্য অনুযায়ী সভ্যজাতিসমুহ কর্তৃক স্বীকৃত আইনের সাধারণ নীতিসমূহ আন্তজার্তিক আইনের এক অন্যতম উৎস।এ সাধারণ নীতিসমূহ দুই প্রকার হতে পারে-
- ১) আন্তজার্তিক আইনের সাধারণ নীতিসমূহ:সাধারণ নীতিসমূহ আন্তজার্তিক আইনের প্রত্যক্ষ উৎস নয়, কিন্তু আন্তজার্তিক আইনের উৎস নির্ণয়ে সহায়তা করে।
আন্তজার্তিক আইনের একটা নীতি হচ্ছে, যে কোন চুক্তিভঙ্গের ফলে যে পক্ষের ক্ষতিসাধিত হয় সে পক্ষ ক্ষতিপূরণ পাবে।
- ২) রাষ্ট্রীয় আইনের সাধারণ নীতিসমূহ:অনেক সময় রাষ্ট্রীয় আইনের সাধারণ নীতি সমূহ আন্তজার্তিক আইনে সাধারণ নীতিরুপে কাজ করে।
রাষ্ট্রীয় আইনের কিছু নীতিমালা আন্তজার্তিক আইনের উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
পৃথিবীর প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের যে আইন ব্যবস্থাগুলোকে বৃহৎ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়-
- ধর্মীয় আইন ব্যবস্থা-মুসলিম আইন,হিন্দু আইন।
- কমন ’ল’ ব্যবস্থা-যুক্তরাজ্য,ভারত,বাংলাদেশ।
- সমাজতান্ত্রিক আইন ব্যবস্থা-চীন,কিউবা।
- সিভিল আইন ব্যবস্থা-ফ্রান্স,জার্মানী,ইতালী।
- প্রথাভিত্তিক আইন ব্যবস্থা- মধ্য আফ্রিকার রাষ্ট্রসমূহ।
- আন্তজার্তিক আদালত কর্তৃক যেসব মামলায় আইনের এ সাধারণ নীতিসমুহ প্রয়োগ করা হয় তন্মেধ্যে) এবং
প্রথম মামলাটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান ও পোল্যন্ডের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পর্কিত। চুক্তিতে একটি বিধান রয়েছে যে, পোল্যন্ডের অন্তভুক্ত আপার সাইলোশিয়াতে জার্মান স্বার্থ সংরক্ষিত হবে এবং সেখানে জার্মানির কিছু কোম্পানী রয়েছে যা বাজেয়াপ্ত করা যাবে না। কিন্তু পোল্যান্ড চুক্তিভঙ্গ করে জার্মানির দুটি কোম্পানী বাজেয়াপ্ত করে। জার্মানী ক্ষতিপূরণ দাবী করে পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে আন্তজার্তিক আদালতে মামলা দায়ের করে। আদালত তার রায়ে বলেন যে, দুটো কোম্পানী বাজেয়াপ্ত করে পোল্যান্ড যে ক্ষতিসাধন করেছে সেজন্য পোল্যান্ড জার্মানীকে ক্ষতি প্রদান দিতে বাধ্য। কারণ আইনের একটি নীতি হচ্ছে যে, কোন চুক্তি ভঙ্গের ফলে যে পক্ষের ক্ষতি সাধিত হয় সে পক্ষ ক্ষতিপূরণ পাবে।