গ্রেফতার সম্পর্কে আইনের বিধান:-
আমলযোগ্য অপরাধ ও অ-আমলযোগ্য অপরাধ বলতে কি বুঝায়?আমলযোগ্য অপরাধ বলতে সেই সকল অপরাধকে বুঝায় যে অপরাধ সংঘটনের সংবাদ প্রাপ্তির সাথে সাথে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ ছাড়াই ঘটনার তদন্ত শুরু করতে পারবেন এবং আসামীকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবেন।
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৪ ধারার বিধান মতে, আমলযোগ্য ঘটনার প্রত্যেক টি সংবাদ এজাহার হিসাবে গণ্য হবে এবং সরকারের নির্ধারিত ফরম মোতাবেক বইয়ে নথিভুক্ত হবে।
অ-আমলযোগ্য অপরাধ বলতে সে সকল অপরাধকে বুঝায়, যে সকল অপরাধ সংঘটন হবার পর, প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কোন ঘটনার তদন্ত করতে পারেন না এবং বিনা পরোয়ানায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারবেন না।
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৫ ধারায় অ- আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটন হলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার করনীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে।
গ্রেফতার,হামলা, মামলা প্রভৃতি শব্দ গুলি দৈনন্দিন জীবনে যেন স্বাভাবিক ব্যপার ! চলুন আজ সংক্ষেপে জেনে নিই গ্রেফতার সম্পর্কে আইনের বিধানে কি আছ :
√ পুলিশ কোন ব্যাক্তিকে ওয়ারেন্ট বা ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার অধীনে যুক্তিসঙ্গত সন্দেহে বা অন্য কোন কারনে গ্রেফতার করার অধিকার রাখে।
√ কার্যবিধির ধারা ৮০ অনুসারে ওয়ারেন্ট এর অধীনে গ্রেফতার এর ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি ওয়ারেন্ট দেখতে চাইতে পারেন ।
√ বাংলাদেশ সংবিধান এর অনুচ্ছেদ ৩৩ অনুসারে, গ্রেফতারকৃত কোন ব্যাক্তিকে আটকের কারন না জানিয়ে আটক রাখা যাবে না ; আটক ব্যাক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শের বা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এতে আরও বলা আছে যে, গ্রেফতারকৃত ব্যাক্তিকে অবশ্যই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট হাজির করতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেট এর আদেশ ব্যাতিত তাকে ২৪ ঘণ্টার বেশি আটক রাখা যাবে না।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ এবং ১৬৭ ধারায় কোনো ব্যক্তিকে ‘গ্রেপ্তার করা ও রিমান্ডে নেয়ার’ বিষয়ে বেশকিছু নির্দেশনা ‘বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের’ নির্দেশ:
২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল মহামান্য উচ্চ আদালতের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো: হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ‘ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ সরকার’ মামলায় এবং
২০০৩ সালের ৪ আগস্ট তৎকালীন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এস কে সিনহা (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি শরিফউদ্দীন চাকলাদার ‘সাইফুজ্জামান বনাম বাংলাদেশ সরকার’ মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ এবং ১৬৭ ধারায় কোনো ব্যক্তিকে ‘গ্রেপ্তার করা ও রিমান্ডে নেয়ার‘ বিষয়ে বেশকিছু নির্দেশনা ‘বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের’ নির্দেশ দিয়েছিলেন। যা আজও যুগান্তকারী ও অত্যাধুনিক নির্দেশনা হিসাবেই আইন পাড়ায় সমাদৃত। তবে দুঃখের বিষয় হলো, আজ পর্যন্ত মাননীয় বিচারপতিদের সেই রায়টি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ জানে না এবং আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মহামান্য উচ্চ আদালতের সেই যুগান্তকারী রায়টি সঠিকভাবে পালন করছেন না।
রায়টি জনস্বার্থে উল্লেখ করা হলো – এই নির্দেশনাগুলোর আলোকে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্যগুলো নিম্নরূপ:
০১। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেবার জন্য পুলিশ কোনো ব্যক্তিকেই ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবেন না।
০২। কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের আগে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার তাঁর পরিচয় দেবেন এবং প্রয়োজনে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিসহ উপস্থিত অন্যরাও পরিচয়পত্র দেখাবেন।
০৩। গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে থানায় নিয়ে আসার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার দ্রুত গ্রেপ্তারের কারণগুলো (অভিযোগ) লিখে রাখবেন। সেখানে থাকবে- আমলযোগ্য অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য, অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ, যে পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার তথ্য, তথ্যের উৎস ও তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার কারণ এবং স্থানের বর্ণনা, সময়, গ্রেপ্তারের সময় উপস্থিত ব্যক্তিদের নাম ঠিকানা থানার ডায়েরিতে লিখে রাখতে হবে।
০৪। গ্রেপ্তার ব্যক্তির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পেলে পুলিশ তা লিখে রাখবেন এবং কাছাকাছি কোনো হাসপাতালে বা সরকারি ডাক্তারকে দেখিয়ে চিকিৎসা করে তার কাগজপত্র সংগ্রহ করবেন।
০৫। গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে থানায় আনার তিন (০৩) ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ গ্রেপ্তারের কারণ / অভিযোগপত্র তৈরি করবেন।
০৬। কোনো ব্যক্তিকে বাসস্থান বা কর্মস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা না হলে তাকে থানায় আনার এক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ তার আত্মীয়-স্বজনদেরকে টেলিফোনে বা লোক মারফত গ্রেপ্তারের সংবাদ জানাবেন।
০৭। পুলিশ গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে তার পছন্দনীয় আইনজীবী বা নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ বা দেখা করার অনুমতি দিতে বাধ্য থাকবেন।
০৮। যখন কোনো গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাজির করা হয়, তখন পুলিশ কর্মকর্তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ (১) ধারা অনুযায়ী লিখিত বক্তব্য পেশ করবেন যে, কেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন হয়নি এবং কেন তিনি মনে করেন যে, গ্রেপ্তার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ বা তথ্যগুলো যুক্তিসংগত ও সুদৃঢ় । একইসঙ্গে তিনি মামলার প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে পেশ করবেন।
০৯। যদি ম্যাজিস্ট্র্টে তদন্তকারী কর্মকর্তার পাঠানো পত্রে ও মামলার লিখিত ডায়েরির বর্ণনা পড়ে সন্তুষ্ট হন যে, গ্রেপ্তার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ বা তথ্যগুলো যুক্তিসঙ্গত এবং তাকে জেলে রাখার যথেষ্ঠ উপকরণ মামলার ডায়েরিতে রয়েছে, তবে তিনি গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠানোর নিদের্শ দেবেন। অন্যথায় তাৎক্ষণিক তাকে মুক্তি দেবেন।
১০। গ্রেপ্তার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো যুক্তিসঙ্গত না হওয়ায় এবং তাকে জেলে রাখার যথেষ্ট উপকরণ মামলার ডায়েরিতে না থাকায় যদি ম্যাজিস্ট্রেট ওই ব্যক্তিকে মুক্তি দেন তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ (১)(গ) ধারায় ওই ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে আইনগত কার্যক্রম শুরু করবেন । একইসঙ্গে ওয়ারেন্ট ছাড়া ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার কারণে ওই পুলিশ অফিসার দ-বিধির ২২০ ধারা অনুযায়ী বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে বা উৎকোচ নিয়ে ওই ব্যক্তিকে আটক রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন।
১১। গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেট পুনরায় জেলহাজতে পাঠানোর পরও সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার তদন্তের প্রয়োজনে ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নির্ধারিত কক্ষটি নিম্নলিখিত শর্তানুযায়ী হতে হবে । শর্তগুলো হলো- জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষটির এক পাশে কাঁচের দেয়াল ও গ্রিল থাকবে, যাতে গ্রেপ্তার ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন বা আইনজীবী জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্যটি দেখতে পারেন কিন্তু শুনতে পাবেন না। গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেবার আবেদনপত্রে জিজ্ঞাসাবাদের বিস্তারিত যুক্তিসঙ্গত কারণ উল্লেখ করতে হবে। বিবেচনার জন্য মামলার কেস ডায়েরিটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পেশ করতে হবে । যদি ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনে সন্তুষ্ট হন, তাহলে তিনি কারণগুলো লিখে নিয়ে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে পুলিশ হেফাজতে পাঠানোর আদেশ দেবেন। তবে সেটা তিন দিনের বেশি অবশ্যই নয়।
১২। যদি ম্যাজিস্ট্র্টে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে পুলিশ হেফাজতে নেবার জন্য পুনরায় আদেশ দেন তবে এই মর্মে নিশ্চিত হবেন যে- গ্রেপ্তারের সময় ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কারণ জানানো হয়েছিল, পছন্দনীয় আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের সুযোগ দেয়া হয়েছিল, পুলিশ হেফাজতে পাঠানোর আগে ম্যাজিস্ট্রেট আটক ব্যক্তির আইনজীবীর বক্তব্যও শুনবেন। ওই ম্যাজিস্ট্রেট আটক ব্যক্তিকে পুনরায় পুলিশ হেফাজতে পাঠানোর এই আদেশ অনুমোদনের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলার দায়রা জজ/মেট্রোপলিটন দায়রা জজের কাছে পাঠাবেন। অনুমোদন পাওয়ার গেলে হেফাজতে নেয়ার আগে তদন্তকারী কর্মকর্তা অবশ্যই নির্দিষ্ট সরকারি ডাক্তার বা মেডিকেল বোর্ড দ্বারা আটক ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করবেন এবং ডাক্তারি প্রতিবেদন ওই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পেশ করবেন। যদি ম্যাজিস্ট্রেট ডাক্তার বা মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদনে পুলিশ হেফাজতে আটক ব্যক্তিকে নির্যাতনের বা আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার কোনো প্রমাণ পান তবে তিনি ফৌজদারি কার্যবিধি ১৯০ (১) (গ) ধারায় ওই পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে আইনগত কার্যক্রম শুরু করবেন। একইসঙ্গে ওই পুলিশ অফিসার দ-বিধির ৩৩০ ধারা অনুযায়ী, ভিত্তিহীন/ অযৌক্তিক অপরাধে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য আটক ব্যক্তিকে নির্যাতন/পীড়ন করার অপরাধে অভিযুক্ত হবেন। যার সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদে সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদ-। একই সঙ্গে অর্থদ-ও হতে পারে।
১৩। যদি থানা পুলিশ হেফাজত/জেলখানায় আটক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে তবে সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তা/তদন্তকারী কর্মকর্তা/তদন্তকারী অফিসার/ জেলার এই মৃত্যুর খবর তৎক্ষণিক কাছের ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাবেন।
১৪। পুলিশ হেফাজতে বা জেলে মৃত্যুর সংবাদ পাবার পর অবশ্যই ম্যাজিস্ট্রেট অতিদ্রুত ঘটনাস্থলে যাবেন এবং কোন ধরনের অস্ত্রে বা কিভাবে শরীরে ক্ষত হয়েছে তা উল্লেখ করে মৃত্যু কিভাবে হয়েছে তার একটি প্রতিবেদন তৈরি করবেন। একইসঙ্গে মৃত ব্যক্তির ময়না তদন্তের ব্যবস্থা করবেন।
১৫। উপর্যুক্ত নির্দেশনাগুলো যথাসময়ে ও যথাযথভাবে মেনে না চললে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালত অবমাননার অপরাধে অভিযুক্ত হবেন।