নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন :
পুলিশ হেফাজতে আসামির মৃত্যুর ঘটনাও প্রায়ই ঘটে থাকে। এমন মৃত্যু নিবারণের উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে প্রণয়ন করা হয় নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন। এ আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। নির্যাতনের মাধ্যমে কারো মৃত্যু ঘটানো হলে এই সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যাবে। আর শুধু নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে নির্যাতনের গভীরতা বিবেচনায় বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, কারাদণ্ড অথবা জরিমানা করতে পারবেন আদালত। সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। আইনে এমন ফাঁক রাখা হয়েছে যে হেফাজতে নির্যাতন করে মৃত্যু ঘটিয়ে অপরাধী শুধু জরিমানা দিয়েই মুক্তি পেতে পারবে।
অস্ত্র আইন :
১৮৭৮ সালে প্রণীত হয় অস্ত্র আইন। এরপর আর আইনটি যুগোপযোগী করা হয়নি। সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, অনুমোদনহীন অস্ত্রশস্ত্র বলতে আগ্নেয়াস্ত্র, বেয়নেট, তরবারি, ছোরা, বর্শা, বর্শার ফলক, তীর-ধনুক বা অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম বোঝাবে। বিভিন্ন ধারায় সরকারি অনুমোদন ছাড়া অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার, প্রদর্শন, ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি-রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রায়ই দেখা যায়, বিভিন্ন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম তথা মারামারি, হাঙ্গামা ইত্যাদির সময় প্রভাবশালী অনেকেই অস্ত্র প্রদর্শন করে থাকে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হয় না। এর মধ্যে এ আইনের ১৯ এ ও ১৯ এফ ধারায়ই সাধারণত অবৈধ অস্ত্র দখলদারের বিরুদ্ধে মামলা হয়। অস্ত্র কারো জ্ঞানমতে (নলেজ), দখলে ও নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে বলে আইনে উল্লেখ থাকায় যার কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার বা জব্দ হয় তাকে ছাড়া অন্য কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি দূর থেকে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের আইনের আওতায় আনা যায় না। কারণ ‘নিয়ন্ত্রণ’ উপাদানটি প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য।
শিশু আইন :
শিশুর প্রতি নির্যাতন (হত্যা, ধর্ষণ) গুরুতর হলে এবং আসামি প্রাপ্তবয়স্ক হলে তার বিচার কোন আইনে বা কোন আদালতে হবে সে বিষয়ে শিশু আইনের অস্পষ্টতা দূরীকরণ প্রশ্নে সরকারের দুই সচিবের কাছে গত মাসে ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। আদালতে শুনানিতে আইনটি সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম। তিনি বলেছেন, শিশু আইনে বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধের শিকার বা ভিকটিম এবং সাক্ষী শিশু হলে ওই মামলার বিচার শিশু আদালতে হবে। কিন্তু শিশুকে ধর্ষণ বা হত্যার মতো গুরুতর অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রাপ্তবয়স্ক আসামির বিচার কোন আইনে বা আদালতে হবে সেটি শিশু আইনে স্পষ্টকরণ করা হয়নি। এই অস্পষ্টতা দূর করতে শিশু আইন সংশোধন করা দরকার।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন :
বিডি ফুডসের মালিকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে হেরোইন চোরাচালানের মামলা হয়েছিল ২০০৬ সালে। বিমানের কার্গোতে করে সবজি ও টাইলস রপ্তানির আড়ালে বিপুল পরিমাণ হেরোইন ব্রিটেনে পাচার করার অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ওই মামলা হয়েছিল। ব্রিটেনে ওই চালান ধরা পড়ে। আলামতও জব্দ হয় সেখানে। এ কারণেই দুর্বল হয় এ দেশে দায়ের করা মামলা। এ মামলার চার্জশিট হলেও আলামত জব্দ নেই বিবেচনায় অব্যাহতি পান বিডি ফুডসের মালিক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে আলামত জব্দের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কার দখল, কার জায়গা থেকে দখল হয়েছে সেটাই মূল উপাদান। এসব মামলার ক্ষেত্রে শুধু বাহকরাই দোষী সাব্যস্ত হয়। নিয়ন্ত্রণকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে আইনের ফাঁকে।
যৌতুক নিরোধ আইন : ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনে যৌতুকের সংজ্ঞায় ফাঁক থাকায় রক্ষা পেয়ে যায় নির্যাতনকারীরা। আইনের ২ ধারায় বলা হয়েছে, বিষয়বস্তু বা প্রসঙ্গে পরিপন্থী না হলে এ আইনে যৌতুক বলতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রদত্ত যেকোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতকে বোঝাবে। যা ক. বিবাহের এক পক্ষ অপর পক্ষকে অথবা খ. বিবাহের কোনো এক পক্ষের পিতা-মাতার বা অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক বিবাহের যেকোনো পক্ষকে বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিবাহ মজলিশে অথবা বিবাহের পূর্বে বা পরে, বিবাহের পণরূপে প্রদান করে বা প্রদান করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। এতে বলা হয়েছে, কোনো উপঢৌকন যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে না।
হাইকোর্ট সম্প্রতি এক রায়ে বলেছেন,
আইনে স্পষ্ট রয়েছে যে বিয়ের শর্ত হিসেবে অর্থ বা সম্পদ দাবি করলে তা যদি বিয়ের মজলিশে বা বিয়ের আগে বা পরে যেকোনো সময় দাবি করা হয়, তবেই যৌতুক দাবি করা হয়েছে বোঝাবে। আদালতের এই সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হয় যে বৈবাহিক সম্পর্ক বলবৎ থাকা অবস্থায় বিবাহের পূর্বশর্ত না থাকা সত্ত্বেও এক পক্ষ আরেক পক্ষের কাছে অর্থ বা সম্পদ দাবি করলে তা যৌতুক বোঝাবে না এবং এমন মামলা খারিজযোগ্য। এর সুযোগ নিয়ে অনেক আসামি সাক্ষ্যগ্রহণের আগেই মামলা থেকে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন :
তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করার বিধানেই রয়েছে বিরাট ফাঁক। কোথায় ভুক্তভোগী মামলা করবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই আইনে। তবে মামলা হচ্ছে। প্রভাবশালীদের মামলা নিচ্ছে থানার পুলিশ। আবার অনেকের মামলাই নিচ্ছে না। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করতে গেলে আইনে কিছু বলা না থাকার অজুহাতে ম্যাজিস্ট্রেটরা মামলা গ্রহণ করেন না। আবার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে গেলে ওই ট্রাইব্যুনালও মামলা নেন না। পুলিশের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই নির্ভর করে কারো বিচার পাওয়ার অধিকার।
অর্থঋণ আইন :
১৯৯১ সালের অর্থঋণ আইনে ঋণখেলাপির সংজ্ঞাই নেই। এ কারণে ঋণখেলাপিরা মোটা অঙ্কের ব্যাংকঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছেন না। আইনের ফাঁক বের করে ঋণখেলাপিরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আইন সংশোধন করতে সুপারিশ করেছে। আইন কমিশনও আইনটি সংশোধনের জন্য সুপারিশ করেছে।
দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি :
বাংলাদেশের বিচার কার্যক্রম চলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী। শাস্তির বিধানসংবলিত প্রচলিত দণ্ডবিধিতে আসামি করা হলে দুই ধরনের ধারায় তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। কিছু ধারা আছে জামিনযোগ্য। কিছু ধারা আছে জামিনের অযোগ্য। জামিনের অযোগ্য ধারার অপরাধগুলো সাধারণত মারাত্মক অপরাধ বলেই বিবেচনা করা হয়। সাধারণ অর্থে বোঝা যায়, জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার হওয়া আসামি জামিন পাবে না। কিন্তু আইনে রয়েছে মারাত্মক ফাঁক। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬ ধারায় জামিনযোগ্য ধারায় আদালতকে জামিন দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আবার ৪৯৭ ধারায়ও জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার আসামিকে জামিন দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়।
মানহানির মামলা :
মানহানির অভিযোগে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হয় দণ্ডবিধির ৫০০, ৫০১ ও ৫০২ ধারায়। আদালতে নালিশি মামলা করে যে ব্যক্তির মানহানি হয়েছে তিনি প্রতিকার চাইতে পারেন। এসব ধারায় মামলা করলে বিচারক সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন। সরকার ঘোষণা দিয়ে আইন সংশোধন করে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রথমেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা যাবে না বলে আইন সংশোধন করা হয়। কিন্তু দেখা গেছে, শুধু ৫০০ ধারা সংশোধন করা হয়েছে। ওই ধারাটি সংশোধন করে বলা হয়েছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা যাবে না। কিন্তু মামলা করা হয় তিনটি ধারায়। অপর দুটি ধারা সংশোধন না করে ফাঁক রাখা হয়েছে।