আইনজীবী হলেন 'আইন ব্যবসায়ী', যিনি একজন অ্যাডভোকেট, ব্যারিস্টার, অ্যাটর্নি, সলিসিটর বা আইনি উপদেশক। আইনজীবী মূলত আইনের তাত্ত্বিক বিষয়গুলির বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তির বা সংস্থার আইনি সমস্যার সমাধানের কাজ করে থাকেন।
বিভিন্ন
দেশ তাদের নিজ নিজ আইনী ব্যবস্থা অনুযায়ী আইনজীবীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন।
ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী আইন বিষয়ে পারদর্শি এবং সনদপ্রাপ্ত যে কেউ আইনজীবী। কিন্তু স্কটিশ
ভাষায় রচিত ম্যাক্স আইনে বা দক্ষিণ আফ্রিকা, ইতালিয়ান, ফরাসী, স্পেনিয়, পর্তুগিজ,
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, পোলিশ, ইস্রায়েলীয়, দক্ষিণ এশায় এবং দক্ষিণ আমেরিকার আইন ব্যবস্থা
অনুযায়ী অ্যাডভোকেট বলতে উচ্চতর শ্রেণির একজন আইনজীবীকে নির্দেশ করে।
অ্যাডভোকেট
কিছু দেশে আইনজীবীদের সম্বোধনের উপায়ও বটে। যেমন: "এড. স্যার অ্যালবেরিকো জেন্টলি
ব্যুৎপত্তিঃ
অস্ট্রেলিয়ায়
আইনজীবী বলতে সাধারণত সলিসিটর বা ব্যারিস্টার উভয়কেই বোঝানো হয়ে থাকে। ইংল্যান্ডে
ল'ইয়ার বা আইনজীবী বলতে সংরক্ষিত বা অসংরক্ষিত ক্ষেত্রে আইনি সহায়তাদানকারী ব্যক্তিকে
বোঝানো হয়। যাদের মধ্যে ব্যারিস্টার ও সলিসিটর কেও ধরা হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ায়
প্রচলিত কথায় আইনজীবী বলা হলেও আসল শব্দটি হল এ্যাডভোকেট যা এ্যাডভোকেট এক্ট - ১৯৬১
তে সংজ্ঞায়িত করা আছে। স্কটল্যান্ড এ আইনজীবী বলতে আইনে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ব্যক্তিকে
বোঝানো হয়ে থাকে।
দায়িত্বঃ
অধিকাংশ
দেশে আইনের বিভিন্ন ধারার কাজের বিভিন্নতার কারণে আইনপেশার সাথে সংযুক্ত ব্যক্তি থাকেন
যাদের আমেরিকান ধাঁচে লইয়ার বলা যায়না। এ পেশাতে আইনজীবী ছাড়াও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত
থাকে মুহুরি, মোক্তার, আইন কেরানি ও জজ। নানা দেশের আইন ও তার প্রয়োগের বিভিন্নতার
কারণে এই পেশার সাধারণীকৃত সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব না।
অ্যাডভোকেসি এমন একটি পেশা যেখানে কর্মের প্রতি নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং প্রচেষ্টা ছাড়া কোনো ভাবেই উন্নতি সম্ভব না। সঠিক বিচার কাজে সাহায্য করা এবং দোষীকে চিহ্নিত করতে বিচারককে সহায়তা করার ক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন। তাই আইনী পেশাকে মহৎ পেশা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। [ জেএস যাদব বনাম মোস্তফা হাজী মোহাম্মদ ইউসুফ, এআইআর ১৯৯৩, এসসি ১৫৩৫
তবে সাধারণ ভাষায় আইনজীবী বলতে আমরা সে সকল ব্যক্তিকে বুঝে থাকি যারা আইনের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে নানা ধরনের মামলার পক্ষে-বিপক্ষে আদালতে দলিল, সাক্ষ্য ও যুক্তি পেশ করে মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়তা করেন।
তাই
আইনজীবীদের কাজ সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ সম্পাদন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কেননা তাদের
একটি মিথ্যা দলিলের জন্য একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারে।
এই
পেশাটি একদিকে যেমন মর্যাদার অন্যদিকে তেমনি দায়িত্বেরও বটে।
শিক্ষাঃ
বিভিন্ন
দেশে আইনের শিক্ষাপ্রণালী ও যোগ্যতা বিভিন্ন প্রকার। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন
বিভাগে পঠন পাঠন হয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান পরীক্ষা, উপযুক্ত সরকারি
প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের ল স্কুল গুলিতে পড়ানো
হয় এবং আমেরিকায় বার এসোসিয়েশন বা আইনজীবী সংঘ ঠিক করে কোন ল স্কুলের ডিগ্রী গ্রহণযোগ্য
ও সর্বোত্তম। আমেরিকার মত কানাডাতে (কুইবেক বাদে) স্নাতক স্তরের আইন ডিগ্রি ল স্কুল
গুলি থেকে দেওয়া হয় এবং এগুলির প্রায় সবই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। অন্যান্য
সমস্ত মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলিতে পূর্ণ সময়ের আইন শিক্ষার প্রচলন আছে। উন্নয়নশীল
দেশে অবশ্য আংশিক সময়ের শিক্ষা প্রচলিত, যেখানে ছাত্রদের কাজ করা ও তার উপার্জিত অর্থে
পড়াশোনা করার রীতি প্রচলিত।
ভারতঃ
ভারতে
১৯৬১ সালে তৎকালীন আইনমন্ত্রী অশোক কুমার সেন Advocates Act-1961[৪] মে একটি নতুন আইন
উপস্থাপন করেন এবং তা সংসদে পাশ হওয়ার মাধ্যমে দেশের আইন সংক্রান্ত বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণ,
পর্যালোচনা এবং আইন প্রয়োগের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হয় বার কাউন্সিলকে।
যার
ফলে বার কাউন্সিল পরিচালনার জন্য ভারতে আইনজীবীর চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
ভারতে আইনজীবী হতে হলে যে পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে তা হলো :
- যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় (যেখান আইন বিভাগ রয়েছে) থেকে আইন ডিগ্রি অর্জন করতে হবে।
- বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
- বার কাউন্সিলের সদস্য পদ লাভের মাধ্যমেই সে দেশের একজন আইনজীবীর মর্যাদা লাভ করবে।
পাকিস্তানঃ
পাকিস্তানে
বিভিন্ন স্তরের আইনজীবী প্রথা প্রচলিত।
আইনজীবীঃ
- যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩ বছরের এলএলবি করতে হবে।
- কোনো সিনিয়র আইনজীবীর অধীনে কমপক্ষে ৬ মাস অনুশীলন করতে হবে।
- বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় পাশ করে সদস্য পদ লাভ করতে হবে।
হাই কোর্টের আইনজীবী
আইনজীবী
হিসেবে ২ বছর কাজ করার পর একজন ব্যক্তি হাইকোর্টের আইনজীবী হওয়ার জন্য আবেদন করতে
পারবে এবং সাক্ষাৎকারের এর পর সে যদি যোগ্য প্রার্থী হয় তবে হাই কোর্টে প্র্যাকটিসের
লাইন্সেস পাবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীঃ
হাই
কোর্টে ১০ বছর সফল ভাবে প্র্যাকটিসের পর একজন আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী হিসেবে
যোগদানের যোগ্যতা অর্জন করে এবং আবেদন করার পর তা পাকিস্তান বার কাউন্সিল ও সুপ্রিম
কোর্টের বিচারক কর্তৃক মূল্যায়নের মাধ্যমে তাকে লাইসেন্স প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশঃ
উচ্চমাধ্যমিক
সার্টিফিকেট পরীক্ষার পর ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আইন বিভাগে অধ্যয়নের
জন্য দেশের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। এরপর ৪ বছরের এলএলবি করার মাধ্যমে
সেই ব্যক্তি বার কাউন্সিলের সদস্য পদ লাভের যোগ্যতা অর্জন করে।
বার
কাউন্সিলের পরীক্ষায় পাশ করলেই সে আইনজীবী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করতে পারে এবং
২ বছর নিম্ন আদালতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকলে সে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হওয়ার লাইসেন্স
লাভ করে।[৫]
পেশাগত আচরণবিধিঃ
একজন
আইনজীবীর জন্য বেশ কিছু আচরণবিধি রয়েছে যা অবশ্য পালনীয়।
আইনজীবীদের আচরণবিধির প্রধান দিকসমূহ:
- একজন আইনজীবীর প্রধান দায়িত্ব তার আইন পেশা এবং নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা।
- অসাধু উপায় অবলম্বন করে কোনো কাজ করার বা নিয়োগ প্রাপ্তির চেষ্টা করবেন না।
- সর্বদা সত্যের পথে থাকবেন। কখনও মিথ্যাকে সাহায্য করবেন না।
- কোনো আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে বা তার সম্মতি ছাড়া তার মক্কেলের সাথে কথা বলবেন না।
- আইনজীবীগণ কার্ম জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনকে পৃথক রাখবেন।
- জুনিয়র আইনজীবীরা সিনিয়র আইনজীবীদের সম্মান করবেন তদ্রূপ সিনিয়র আইনজীবীগণ জুনিয়রদের সাহায্য করবেন।
- একজন মক্কেলের পক্ষে একাধিক আইনজীবী থাকলে সিনিয়র আইনজীবী মামলা পরিচালনা করবেন।
- ইতিহাস
প্রাচীন গ্রিসে
অতীতে
লইয়ার বা আইনজীবী বলেতে প্রাচীন এথেন্সে সুবক্তা, বোঝানো হত। সমস্যা হলো এথেনীয় বক্তারা
তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী নিজেদের মামলায় নিজেরাই লড়তেন। অন্য ব্যক্তির আইনি মামলায়
বন্ধু বা সহকারী হিসেবে দাঁড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। দ্বিতীয়ত অন্যের কেসে পারিশ্রমিক
নেওয়ার নিয়ম ছিলনা। সেই কারণে বক্তাদের পুরোপুরি আইনি সহায়ক হিসেবে বিবেচিত করা
যেতনা এথেনীয় আইন অনুসারে। বন্ধুর সহায়ক হিসেবে বিনামূল্য আইনি সাহায্য দানের মধ্যেই
এই পেশা আবদ্ধ থাকায় এদের পেশাগতভাবে লইয়ার বলা যায়না। যিনি এই কাজ ন্যায্য পারিশ্রমিকস্বরূপ
পেশা হিসেবে করেন তাকেই আইনজীবী বলা যায়।
প্রাচীন
রোমে
খ্রিস্টপূর্ব
২০৪ সালের আইনে রোমান আইনজীবীদের পারিশ্রমিক নেওয়ায় বাধা থাকায় আইনের প্রয়োগটিই
অবহেলিত হয়। রোমান সম্রাট ক্লদিয়াসের আমলে এ বাধা উঠে যায়। ফ্রিটজ শুলজ এর মতে,
চতুর্থ শতকে সাম্রাজ্যে আইনজীবীর ধারণা বদলাতে থাকে। তাদের কোনো বার বা সংগঠনে নাম
নথিভুক্ত করে আদালতে সওয়াল করার পূর্ণ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। রোম সম্রাট লিওর নির্দেশ
ছিল নতুন আইনজীবীদের নিয়ে আসতে হবে তাদের শিক্ষকদের শংসাপত্র এবং চার বছরের আইন শিক্ষার
যোগ্যতা অর্জন করার পরেই আদালতে পেশাজীবী হিসেবে প্রবেশাধিকার পাবেন তারা।
মধ্যযুগে
রোম
সাম্রাজ্যের পতনের পর এই পেশার কিছু অবনতি হয়। জেমস ব্রান্ডেজের মতে পাশ্চাত্য ইউরোপের
কাউকে সেই অর্থে পেশাদার আইনজীবী বলা যেত না। ১১৫০ সালে কিছু বাক্তি আইনে অভিজ্ঞ হন
তাও বিশেষ উদ্দেশ্যে। তারা রোমান ক্যাথলিক চার্চের পুরোহিত হিসেবে কাজ করতেন। ১২৩১
সালে ফরাসি কাউন্সিল নিয়ম প্রণয়ন করে যে কেউ এই পেশায় আসার আগে, বিশপ আদালতে শপথ
করতে হবে। পেশাদারিত্ব প্রমাণ করার জন্যে প্রায় সারা ইউরোপেই নতুন নতুন আইন ও বিধিনিষেধ
প্রণয়ন হতে থাকে। ইংল্যান্ডে ১২৭৫ সালে আইন পাশ করা হয় এবং অপেশাদারি ও ত্রুটির জন্যে
আইনজীবীদের সাজার বিধান দেওয়া হয়।
আমেরিকা
১৭০০
সালের দিকে আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে আইনী পেশা বা আইনজীবীরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সে
সময়ে ইংলিশ সাধারণ আইনে পারদর্শী মানুষের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেতে থাকে তেমনি বৃদ্ধি
পেতে থাকে তাদের ক্ষমতা। ২১ শতকের দিকে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে আইনে ডিগ্রী অর্জন করে এবং আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করে।
ভারত
ব্রিটিশ
উপনিবেশের অংশ হওয়ার কারণে ভারতে কোর্ট এবং আইনজীবীর গুরুত্ব ও চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি
পায়। সে সময়ে ভারতে বর্ণপ্রথার প্রচলনের কারণে বেশির ভাগ আইনজীবী আসতো উচ্চশ্রেণির
ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে। ফলস্বরূপ কেবল উচ্চশ্রেণির মানুষরাই এইসব আদালতে বিচার দাবি
করতে পারতো। সাধারণ জনগণের তেমন কোনো সুযোগ ছিলো না।
বাংলাদেশ
১৯৭১
সালে পাকিস্তান হতে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে নিজস্ব সংবিধান গঠন এবং আইনী ব্যবস্থার
প্রচলন হয়। আইনী কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র আইন বিভাগ
চালু করা হয়।