ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় হাইকোর্ট বিভাগের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা একটি অসাধারণ ক্ষমতা যার দ্বারা আদালত বিচার প্রার্থীকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে এবং আদালতের প্রক্রিয়ার অপব্যবহার রোধ করে। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় শুধুমাত্র হাইকোর্ট বিভাগকে ৫৬১ক ধারা মোতাবেক Inherent Power বা অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রদান করা হইয়াছে। সুতরাং, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ক ধারার শিরোনাম হল "হাইকোর্ট বিভাগের অন্তর্নিহিত ক্ষমতার সঞ্চয়"।
ফৌজদারি আইনের অপরিহার্য উদ্দেশ্য হল অপরাধীদের সম্ভাব্য আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তির হুমকি দেয়া এবং আইন ভাঙার বিরুদ্ধে সমাজকে রক্ষা করা।
৫৬১ক ধারা যুক্ত করার ইতিহাসঃ
আইনপ্রণেতাগণ ১৯২৩ সালে ফৌজদারী কার্যবিধি-১৮৯৮ সংশোধনের মাধ্যমে এর ৫৬১ক ধারাটি সংযুক্ত করা হইয়াছিল। আইনপ্রণেতাগণ উপলব্ধি করিয়াছিল যে, ভবিষৎ এমন কোন পরিস্থিতি উপস্থিত হইতে পারে যাহা পুর্ব হইতে অনুমান করা সম্ভব নয়। এসকল পরিস্থিতিতে কার্যকৃত আইন মোতাবেক পক্ষসমুহকে সুনিশ্চিত ও সুষ্ঠ প্রতিকার দেওয়ার লক্ষে ৫৬১ক ধারার ফৌজদারী কার্যবিধিতে সংযুক্ত করা হয়। যাহা ফৌজদারী বিচার ব্যভস্থায় শুধু মাত্র হাইকোর্টকে প্রদান করয়ো উক্ত ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করা হইয়াছে।
৫৬১ক ধারার বিশ্লেষণঃ
৫৬১ক ধারার শিরোনাম-হাইকোর্ট বিভাগের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা সংরক্ষণ।
৫৬১ক ধারায় বলা হইয়াছে যে,
"এই বিধির অধীনে কোন আদেশ কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় হতে পারে, অথবা কোন আদালতের প্রক্রিয়ার অপব্যবহার রোধ করতে বা ন্যায়বিচার সুরক্ষিত বা সুনিশ্চিত করিতে হাইকোর্ট বিভাগকে অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রদান করা হইয়াছে যাহা এই আইনের কোন কিছুই হাইকোর্টকে সীমাবদ্ধ বা প্রভাবিত করিবে না। ”
যদি আমরা অধ্যায়টি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করি, আমরা ৫৬১ক থেকে এর প্রভাব খুঁজে পাই, এ ধারায় বলা আছে যে,
"এই কোডের কোন কিছুই হাইকোর্ট বিভাগের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ বা প্রভাবিত করবে না"
উক্ত ক্ষেত্রে "shall be" শব্দটি ব্যবহার করা হইয়াছে যাহা হাইকোর্ট বিভাগের সীমাহীন ক্ষমতা প্রদান করা হইয়াছে। এবং উক্তরুপ ক্ষমতা শুধুমাত্র হইকোর্ট প্রয়োগ করিতে পারিবেন।
এছাড়াও আরো বলা আছে যে,
এই কোডের অধীনে কোন আদেশ কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে, অথবা কোন আদালতের প্রক্রিয়ার অপব্যবহার রোধ করতে বা অন্যথায় ন্যায়বিচা সুরক্ষিত করতে"
তাহলে আমরা দেখতে পায় যে, অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ব্যবহার করা যেতে পারে তার মধ্যে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে, যথা:
- ক) এই কোডের অধীন কোন আদেশ কার্যকর করার জন্য,
- খ) আদালতের প্রক্রিয়ার অপব্যবহার রোধ করতে এবং
- গ) ন্যায়বিচারের প্রান্ত সুরক্ষিত করা।
৫৬১ক ধারার হাইকোর্ট বিভাগের অন্তনিহিত ক্ষমতার মুল বিবেচ্য বিষয় হল এই আদেশ আদালতের কার্যধারার অপব্যবহার রোধ করবে এবং ন্যয় বিচার নিশ্চিত করিবে।
অন্তনিহিত ক্ষমতা আদালতের ইচ্ছাধীন বা সহজাত বা বিবেচনামুলক ক্ষমতা।
এই আইনে কোন কিছু সীমাবদ্ধ বা ক্ষুণ্ণ বলে গণ্য হবে না। ৫৬১ ক ধারা হাইকোর্ট বিভাগের বিকল্প অতিরিক্ত নয়। এই ধারাটি ফৌজদারী কার্যবিধির গতিপথ পরিবর্তন করা যাবে না।
এই কোডের কোন কিছুই হাইকোর্ট বিভাগের অন্তনিহিত ক্ষমতাকে প্রভাবিত করবে না। ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় ৫৬১ ক ধারা মোতাবেক অন্তনিহিত ক্ষমতা একটি অসাধারণ ক্ষমতা যাহার মাধ্যমে আদালত ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে এবং আদালতের প্রতি জনগনের অস্থা অবিচল করিতে সাহায্য করে।
৫৬১ক হাইকোর্ট বিভাগের অন্তনিহিত ক্ষমতার উপাদানঃ
৫৬১ক ধারা মোতাবেক হাইকোর্ট বিভাগ ৩টি ক্ষেত্রে অন্তনিহিত ক্ষমতা প্রদান করিতে পারেন যথাঃ
- ১। ফৌজদারী কার্যবিধির অধীনে প্রদপ্ত কোন আদেশ কার্যকর করার জন্যঃ
- ২। কোন আদালতের অপব্যবহার রোধ করার জন্যঃ
- ৩। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করিতেঃ
১। ফৌজদারী কার্যবিধির অধীনে প্রদপ্ত কোন আদেশ কার্যকর করার জন্যঃ
ফৌজদারী বিচার কার্যক্রম পরিচালনাকালীন আদালত ফৌজদারী কার্যবিধির অধীনে প্রদপ্ত কোন আদেশ যদি আইন বহির্ভূত প্রদান করেন উক্ত ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ ৫৬১ক মোতাবেক এরুপ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ তাহার অন্তনিহিত ক্ষমতা বলে উক্ত আদেশ বাতিল করিতে পারিবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবেন।
উদাহরণঃ
বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী পরী মনি বনাম রাষ্ট
মামলায় জামিন আবেদনের শুনানির দিন দেরিতে নির্ধারণ করা নিয়ে জজ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন পরীমনি। হাইকোর্ট রুল দেন। পরে জজ আদালত পরীমনির জামিন আবেদনের ওপর শুনানির তারিখ এগিয়ে আনেন।
উক্ত মামলায় পরীমনিকে প্রথমে চার দিন, দ্বিতীয় দফায় দুদিন, তৃতীয় দফায় এক দিনসহ মোট সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
হাইকোর্টে পরীমনির ৫৬১ক দারা মোতাবেক আবেদনের শুনানিতে তাঁকে দফায় দফায় রিমান্ড নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুরের ব্যাপারে দুই বিচারকেরদের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেন। এ ছাড়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাজী গোলাম মোস্তাফাকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন।
নিম্ন আদালতের ২ বিচারক হাইকোর্টের নিকট ক্ষমমা প্রার্থণা করেন।
২। কোন আদালতের অপব্যবহার রোধ করার জন্যঃ
কোন ব্যক্তি যোগসাজেসের মাধ্যমে আদালত যদি কোন ক্রমে প্রভাবিত হন এবং তাহার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অবৈধ্য লাভবান হন উক্ত ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ ৫৬১ ক ধারা প্রয়োগ করিবেন আদালতের অপব্যবহার রোধ করার জন্য।
উদাহরণঃ
আরিফ বনাম ফরিয়াদী রনি
আরিফ একটি হত্যা মামলার আসামী। আদালত রায় ঘোষণার দিন ধার্য করিলে। জনাব আরিফ উক্ত আদালতের পেশকার মারফত ম্যজিষ্ট্রেট সাহেবের সহিত যোগ সাজেস করেন যে তাহাকে খালাস প্রদান করিতে হইবে। বিনিময়ে তিতি ৫ লক্ষ টাকা প্রদান করিবেন। উক্ত মামলায় জনাব আরিফ খালাস প্রাপ্ত হন। বাদী উক্ত বিষয়টি জানিতে পারিয়া
হাইকোর্ট বিভাগে ৫৬১ক মোতাবেক আবেদন করেন
৩। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করিতেঃ
ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় কোন রুপ আইন না থাকিলে উক্ত বিষয় নিস্পত্তিকল্পে হাইকোর্ট ন্যায় বিচারের স্বার্থে ৫৬১ ক ধারা প্রয়োগ করিবেন।
উদাহরণঃ
হাইকোর্ট বিভাগের একটি অন্তনিহিত ক্ষমতার বৈশিষ্টঃ
- ক) ৫৬১ক ধারার অন্তনির্হিত ক্ষমতা আদালতের সহজাত ক্ষমতা।
- খ) শুধুমাত্র হাইকোর্ট উক্ত ধারাটি প্রয়োগ করিতে পারেন।
- গ) যে কোন ব্যক্তি উক্ত ধারা মোতাবেক কোন উপাদানের অন্তভূক্ত হন তিনি হাইকোর্টে আবেদন করিতে পারিবেন
- ঘ) কোন আদালত আইনের অপব্যবহার করিতে পারিবেন না।
- ঙ) বিচারককে প্রভাবিত করাকে সীমাবদ্ধ করা হইয়াছে।
- চ) ন্যয়ি বিচার নিশ্চিত করা হইয়াছে।
হাইকোর্ট বিভাগের একটি অন্তনিহিত ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাঃ
৫৬১ক ধারা শুধুমাত্র হাইকোর্ট বিভাগ প্রয়োগ করিতে পারিবেন।
সুতরাং বলা যায় যে, হাইকোর্ট বিভাগ ন্যায় বিচার নিশ্চিত করিতে ৫৬১ক ধারা মোতাবেক অন্তনির্হিত ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে পারেন।