ভরণপোষণ বা প্রতিপালন করা বলতে মানুষের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল মৌলিক চাহিদা পূরণ করা।সাধারণত ভরণপোষণ বলতে খাদ্য, বস্ত্র, আবাস, চিকিৎসা, শিক্ষা ও অন্যান্য খরচকে বোঝানো হয়। এছাড়াও,শিক্ষার খরচ, শারীরিক ও মানসিক পুষ্টির জন্যে যাবতীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই এই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। এই ভরণপোষণের জন্য সন্তান নির্ভর করে বাবা-মায়ের উপর, স্ত্রী তার স্বামীর উপর, বয়স্ক বাবা-মা তাদের স্বাবলম্বী সন্তান এর উপর। কিন্তু সবাই যে আন্তরিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করে তা নয়। সেক্ষেত্রে কেউ যদি তার দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আইনের মাধ্যমে তার উপর নির্ভরশীল মানুষদের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য করা যায়।
ভরণপোষণ যারা পায়:
সাধারণত, চার ধরনের মানুষ ভরণপোষণ এর দাবিদার:
- • বাবা-মা সন্তানের কাছ থেকে,
- • স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে,
- • নাবালক পুত্র ও অবিবাহিতা কন্যা বাবার কাছ থেকে,
- • বিধবা পুত্রবধূ শ্বশুর এর কাছ থেকে খোরপোশ পেতে পারেন (শর্তসাপেক্ষে)।
তবে কে ভরণপোষণ পাওয়ার যোগ্য তা নির্ধারণ করবে আদালত, কারণ আইন অনুযায়ী, আর্থিক দিক থেকে যারা সক্ষম তাঁরা দুর্বল বা আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মানুষটিকে ভরণপোষণ দেবেন।ভরণপোষণের মামলার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পারিবারিক আইনের আওতায় ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের পারিবারিক সমস্যাগুলির বিচার করে দেওয়ানি আদালত। বাংলাদেশে ভরণপোষণের জন্য যেসব আইন আছে সেগুলি হল:
- মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১,
- হিন্দু দত্তক গ্রহণ
- ভরণপোষণ আইন ১৯৫৬,
- পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩।
মুসলিম স্ত্রীর ভরণপোষণ অধিকার-
মুসলিম বিয়ে একটি দেওয়ানি চুক্তি। বিয়ের পর ভরণপোষণ হচ্ছে স্বামীর জন্য দায়িত্ব এবং স্ত্রীর জন্য অধিকার। স্বামীর আর্থিক সচ্ছলতার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই এবং তাতে স্ত্রীর অধিকারে কোন প্রকার প্রভাব পড়বে না। মুসলিম পারিবারিক আইনে স্ত্রীর ভরণপোষণ স্বামীর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে, এই অধিকারটি পেতে হলে স্ত্রীকে অবশ্যই স্বামীর সাথে বসবাস করতে হবে। আইনের বিধান মতে কিছু ক্ষেত্রে স্বামীর কাছে স্ত্রীরা ভরণ-পোষণের দাবিদার হবে না, যেমন: স্ত্রী যদি স্বামীর সঙ্গে বসবাস করতে অস্বীকার করেন এবং স্বামীর প্রতি অনুগত না থাকেন; স্বামীর মৃত্যুকালে ইদ্দত পালনকালে বিধবা ভরণ-পোষণ পাবেন না। তবে স্ত্রী যদি অন্ত:সত্ত্বা হন সেক্ষেত্রে সন্তান জন্ম নেয়া পর্যন্ত ভরণ-পোষণ পাবেন। স্ত্রী যদি ব্যভিচারী হন তাহলেও ভরণপোষণ পাবেন না।
হিন্দু স্ত্রীর ভরণপোষণ অধিকার-
স্ত্রী তার জীবনকালে স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী। তবে,কতিপয় ক্ষেত্রে স্ত্রী আলাদা বসবাস করলেও স্বামীর কাছে থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী।
যেমন -স্বামী যদি দুরারোগ্য ব্যাধিতে দীর্ঘকাল আক্রান্ত থাকে, স্বামী যদি নিষ্ঠুর আচরণ করে এবং গৃহে জীবনাশঙ্কার সম্ভাবনা থাকে,স্বামী যদি স্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই তাকে বর্জন করতে চায়,স্বামী যদি অন্য ধর্ম গ্রহণ করে,বা স্ব-গৃহে রক্ষিতা রাখে,অথবা স্বামী যদি স্ত্রীর বর্তমানে আবার বিয়ে করে এবং অন্য কোনো যৌক্তিক কারণে।তবে স্ত্রী যদি ধর্মান্তরিত হয় অথবা যদি আইনসংগত কারণ ছাড়াই স্বামীর সাথে স্ত্রীরূপে বসবাসে অনিচ্ছুক হয় তাহলে সে ভরণপোষণ পাবেনা।
বিবাহ-বিচ্ছেদের পরে ভরণপোষণ-
যদি কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটেই যায় তাহলে বিবাহ-বিচ্ছেদের পরও স্ত্রী ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হবেন। তবে এটি একটি সীমিত অধিকার এবং সীমাবদ্ধ সময় পর্যন্ত বহাল থাকে। মুসলিম বিবাহ-বিচ্ছেদের পর তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে কেবল তিন মাস (৯০ দিন) অর্থাৎ ইদ্দতকালিন সময় পর্যন্ত ভরণপোষণ দিতে হবে। স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে স্ত্রী স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে বা পারিবারিক আদালতে আবেদন বা মোকদ্দমা করতে পারবেন।আদালতে সব ধর্মের অনুসারীগনই মোকদ্দমা করতে পারবেন।
সন্তানের ভরণপোষণ পাবার অধিকার-
সাধারণত সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব পিতার উপর বর্তায়। এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদ মামলা চলাকালীন সন্তান মায়ের কাছে থাকলেও, তার ভরণপোষণের দায়িত্ব বাবার। মুসলিমদের ক্ষেত্রে ছেলের সাবালক হওয়া পর্যন্ত এবং মেয়ের বিয়ে হওয়া পর্যন্ত ভরণপোষণ দেওয়া বাবার দায়িত্ব। হিন্দুদের ক্ষেত্রে কোন সম্পত্তি থাকুক বা না থাকুক, সে তার নাবালক পুত্র, অবিবাহিত কন্যা ও বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।
পিতা-মাতার ভরণপোষণ অধিকার-
বৃদ্ধ ও কর্মহীন বাবা-মা তার সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ অধিকার আদায় করতে পারেন। আইনে প্রত্যেক কর্মক্ষম সন্তানকে তার মা-বাবার ভরণপোষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে বলে বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা রয়েছে। আইন অনুযায়ী পিতা-মাতাকে ভরণ-পোষণ প্রদান না করলে বা আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে সেই সন্তান অনূর্ধ্ব ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
সর্বদা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন,নিজে আইন মেনে চলুন,অন্যকেও আইন মেনে চলতে উৎসাহিত করুন।সবাই আইন ও নিয়ম মেনে চলে একটি সুন্দর সমাজ তথা দেশ ঘটনে অবদান রাখুন