মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুসারে, সম্পত্তিতে বোন ভাইয়ের অর্ধেক পেয়ে থাকে। এটা সর্বজনস্বীকৃত এবং সর্বজন জ্ঞাত। ছেলে বুড়ো সকলেই জানে যে, একটা ছেলে যতটুকু সম্পত্তি পাবে, তার বোন পাবে তার ঠিক অর্ধেক। এক ছেলে এক মেয়ে রেখে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে, সেই ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে স্ত্রীকে তার অংশ দেওয়ার পর অবশিষ্ট সম্পত্তির ৩ ভাগের ২ ভাগ পাবে ছেলে, ১ ভাগ পাবে মেয়ে। এখানে স্ত্রীর অংশের বিষয়ে অনেকেই বেখেয়ালি বা উপেক্ষা করে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে স্ত্রীকে তার প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেওয়া হয় না। বাবার মৃত্যুর পর সরাসরি সম্পত্তি ছেলে এবং মেয়ের মাঝে বণ্টন করে দেওয়া হয়। যদিও মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে আগে তার অংশ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তারপর অবশিষ্ট অংশ ছেলে মেয়েদের মাঝে বণ্টন করা হবে। এই ধারণাটার পিছনে অবশ্যই একটা যুক্তি অনেকেই দাঁড় করিয়েছে, সেটা হচ্ছে, স্ত্রী তথা উক্ত ছেলে মেয়ের মাকে সম্পত্তি যদি দেওয়াও হয়, স্ত্রীর মৃত্যুর পরও পুনরায় উক্ত ছেলে মেয়ের মাঝে একই রেশিও/অনুপাতে বণ্টন হবে। এখানে একটা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে আমাদের সমাজে। এটাকে আমরা ভ্রান্ত ধারণা-১ ধরে নিলাম: অনেকেই এখনো বলে থাকে যে, বাবার সম্পত্তিতে ছেলের অংশ বেশি কিন্তু মায়ের সম্পত্তিতে মেয়ের অংশ বেশি। যার ফলে দলিল তৈরি থেকে শুরু করে পারিবারিক বণ্টনের মধ্যেও অনেক জটিলতা তৈরি হতে দেখা যায়। একটা মজার বিষয় হচ্ছে, অনেক মাকে দেখা যায় সম্পত্তি নিজ জীবদ্দশায় ছেলের নামে হেবা করে দিয়ে দেয়, কেননা তিনি জানেন বা বিশ্বাস করেন যে, ওনার মৃত্যুর পর ওনার ছেলের চেয়ে মেয়ে বেশি অংশ পাবে। অথচ, বাবার সম্পত্তি হোক বা মায়ের, ছেলে মেয়ের মাঝে বণ্টনের বেলায় সেটা একই অনুপাত; অর্থাৎ ছেলেঃমেয়ে=২:১।
আমাদের সমাজে নারীর প্রতি অন্যায়ভাবে একটা ভ্রান্ত ধারণা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, মেয়েরা বাবার বাড়ির সম্পত্তি নিয়ে আসলে তাদের অমঙ্গল হয়। একটাকে আমরা ভ্রান্ত ধারণা-২ ধরে এগুতে পারি। আমাদের দেশে সাধারণত মেয়েদের বিয়ে হওয়ার পর তারা স্বামীর বাড়ি চলে যায় এবং তালাক না হলে মৃত্যু অবধি স্বামীর বাড়িতেই বসবাস করে। বাবা জীবদ্দশায় সম্পত্তি বণ্টন করে না দিলে, মেয়েদেরকে তাদের ভাই বা ভাইয়ের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় নিজের হকের জন্য। আমাদের দেশে যেহেতু বণ্টনের মামলায় অনেক জটিলতা রয়েছে এবং খরচও অনেক, তাই মেয়েরা সাধারণত আপোষ-বণ্টনের মাধ্যমেই নিজেদের হক বুঝে নিতে চায়। কিন্তু, আমাদের দেশে আরেকটি প্রবাদ আছে, শক্তের ভক্ত নরমের যম। যেসব মেয়েদের কাছাকাছি বিবাহ হয় বা স্বামীর বাড়ির দাপট রয়েছে, তারা ঠিকঠাক মতো তাদের অংশ বুঝে নিতে পারলেও যাদের দাপট বলতে সে অর্থে কিছু নেই বা বিয়েও অনেক দূরে হয়েছে, তারা সাধারণত ভাই বা ভাইয়ের ছেলেদের স্বদিচ্ছা ব্যতীত সম্পত্তিতে হক আদায় করে নিতে পারে না।
আরেকটা ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে, ছেলে মেয়ে তো এখন আইনের দৃষ্টিতে সমান, তাহলে সম্পত্তিও এখন সমান সমান। এটাকে আমরা ভ্রান্ত ধারণা-৩ ধরে এগুতে পারি। ভ্রান্ত ধারণা ৩ হচ্ছে, ভ্রান্ত ধারণা ২ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। যেখানে বাংলাদেশের নারীরা এখনো ঠিক মতো নিজেদের হক(এক ভাইয়ের অর্ধেক) আদায় করতে ব্যর্থ, সেখানে আরেকটা ভ্রান্ত ধারণা কিছু কিছু নারীর মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, সরকার এখন নারী পুরুষকে সমান অধিকার দিয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ লাইনটি অসত্য না হলে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুসারে সম্পত্তি বণ্টনের হিসেবটা এসেছে মূলত পবিত্র আল কোরআনের সূরা নিসা থেকে; যা কিনা কেয়ামত পর্যন্ত অপরিবর্তনশীল। তাছাড়া, নারী পুরুষের সমতা মূলত কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে শিক্ষা ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু, মুসলমানদের সম্পত্তি বণ্টন থেকে শুরু করে বিবাহ, তালাক, অভিভাবকত্ব, ভরণপোষণ আইন সমূহ পবিত্র কোরআনে যেভাবে বর্ণীত আছে, যথাসম্ভব সেই অনুসারেই ১৯৬১ এবং ১৯৮৫ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন গুলো তৈরি করা হয়েছে। ব্যক্তিগত আইন যেহেতু নিজ নিজ ধর্ম অনুসারে হয় সেহেতু এই সমতা থাকুক বা না থাকুক, মুসলমানদের সম্পত্তির বণ্টন পুরোপুরিই মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুসারে হবে। অর্থাৎ, ছেলে মেয়ের সম্পত্তি বণ্টনের অনুপাত সর্বদাই ২:১।
উপরিউক্ত ভ্রান্ত ধারণা গুলোই আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। বোনেরা সাধারণত স্বামীর বাড়ি চলে গেলে স্বামীর সম্পদ থেকে অংশ পাবে, এই কারণে অনেক ভাই তার বোনকে সম্পদ দিতে অস্বীকার করে। আবার, কারো কারো ধারণা, বোনদেরকে সম্পত্তি দেওয়া হলে তারা তা বিক্রি করে ফেলবে, তখন নিজেদের সম্পত্তিতে বাহিরের লোক ঢুকে যাবে, এইসব বলেও অনেকেই বাবার সম্পত্তি থেকে বোনদেরকে বঞ্চিত করে। মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অমান্য করে যদি কেউ কারো সম্পত্তির হক নষ্ট করে, তবে এটা কেবল রাষ্ট্রীয় আইন নয়, সরাসরি পবিত্র কোরআন শরীফকে অমান্য করা হল।
সমাধানের পথও কিন্তু আইনে বর্ণীত রয়েছে। কোন কন্যা যদি তার পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয় বা সম্পত্তি বুঝে নিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে তাকে তার পৈত্রিক সম্পত্তি বণ্টনের জন্য বাটোয়ারা মামলা করতে হবে। সম্পত্তি বণ্টন করতে হলে, যার সম্পত্তির বণ্টন করতে হবে তার মৃত্যু সনদ, তার সমগ্র সম্পত্তির কাগজপত্র, ওয়ারিশান সনদ ইত্যাদি সহকারে দেওয়ানী আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। তবে আদালত যাওয়ার আগে যতোটা সম্ভব, ঘরোয়া ভাবে আপোষ বণ্টনের জন্য চেষ্টা করতে হবে। আদালতে মামলা করলে, কোর্ট ফী যে দিতে হবে তেমনি সময়ও দিতে হবে অনেক। কিন্তু, আপোষ বণ্টনের মাধ্যমে দলিল করলে সামান্য খরচেই বণ্টন কার্য সম্পাদন করা সম্ভব। তারপরও পরিবেশ, পরিস্থিতি বিবেচনা করেই এইসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা শ্রেয়।