কালোকে আমরা ভাল চোখে দেখি না যেমন- কালো টাকা, কালোবাজারি, কালো তালিকা, কালো মানুষ (বর্ণ বৈষম্য), শোকের কালো ব্যাচ ইত্যাদি।
তবে কালোর মূল্য কম নয়, কেননা কলমের কালি, গাড়ির টায়ার, কালো তিল (Black Mole), কালোজিরা, ইত্যাদিতে কালো রং প্রাধান্য পেয়েছে।
ইদানীং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, আলো জ্বালিয়ে ঘুমালে মেটাবলিক কার্যক্রমের জটিলতার জন্য মোটা হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়, কিন্তু অন্ধকারে নয়।
বর্তমানে পৃথিবীতে যত এনার্জি সৃষ্টি হয় তার অর্ধেক আসে কালো কয়লা (Coal) থেকে, চোখের মনি কালোতে রমণীদের অধিক রূপ প্রস্ফুটিত হয়। বইপত্রেও উত্কীর্ণ অক্ষরগুলো, তাও কালো রংয়ের। এদিকে শীতকালে তাপ শোষণের জন্যে কালো কাপড় পরিধান করা হয়। এটা সর্বজনবিদিত যে কালো রংয়ে দাগ (Spot) উদ্ভাসিত হয় না। এক্ষেত্রে সাদা রংয়ের এতটুকু দাগেই সব কিছু নষ্ট করে দেয়।
উপরের কথাগুলো অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও রংয়ের নিগুঢ় রহস্য অবতারণা ও প্রতিপাদ্য বিষয় প্রস্ফুটনের জন্য সঙ্গতকারণেই প্রাথমিকভাবে কিছু বিশ্লেষণ তুলে ধরেছি। যাহোক, কেন বিজ্ঞ বিচারক (Bench) এবং বিশেষ করে আইনজীবীদের (Bar) কোট বা গাউন কালো থাকে? সে ব্যাপারে উল্লেখ করার প্রয়াসী হয়েছি। কেননা কম-বেশি সবাই জানেন যে, কালো টুপি (Black Cap) পরে বিজ্ঞ বিচারক অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ (Capital Punishment) দিয়ে থাকেন। তবে কালো গাউন বা কোটের বিষয়টি নিয়ে অনেক মতামত রয়েছে।
তবে স্বীকৃত বিষয় হল, রোমান আইনের কার্যক্রমে কালো কোটের উল্লেখ আছে, যা ইংরেজদের মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক রহস্যের সারথি ধরে উপকথা হিসেবে চলে আসছে। সাধারণত পোশাক-আশাকে রহস্য প্রছন্ন (Dormant) থাকে এবং প্রকারান্তরে পার্থক্য নির্দেশ করে। Bench and Bar এর পোশাকের বিষয়ে বিশেষ করে কালো কোট, কালো গাউন, সাদা বো বা ব্যান্ড ইত্যাদি প্রাচীন পন্থীদের (The old School) মতাদর্শের আলোকে প্রচলিত দুটি পদ্ধতি আছে, যা খুব কম লোকই অবহিত আছেন।
এটি আইন বিজ্ঞানে (Jurisprudence) আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ না থাকলেও আইন পাড়ায় বিশেষ রেওয়াজ (Custom) এবং আচার ভিত্তিক প্রচলিত রীতি (Postulate) হিসেবে পরিচিতি আছে। তবে এ কথা সত্য যে, সুন্নত কিংবা ওয়াজেব নয়, পুরোপুরি ফরজ (অত্যাবশ্যকীয়) যেমন- রাজা তার পোশাক বিহীন সিংহাসনে বসলে যে অবস্থা হবে, তদ্রূপ এজলাসে কালো কোট বা গাউন ব্যতিরেকে সে অবস্থা সৃষ্টি হবে অর্থাত্ সেখানে কোনো বার ও বেঞ্চের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু পোশাক-আশাকের ব্যাপারে আসামি ও ফরিয়াদীর ধরাবাঁধা নিয়ম নেই।
প্রথমত: লক্ষণীয় যে শতাব্দীর পরে শতাব্দী ধরে যে বিষয়টি প্রবাহমান, তা হলো কালো কোট বা গাউন, যা আইন পাড়ায় হাজার বছর ধরে চলে আসছে। এর পিছনে প্রছন্ন রহস্যতে প্রতীয়মান হয় যে আইন অন্ধ (Blind) অর্থাত্ একজন অন্ধ লোকের কাছে সবকিছুই সমান। সাদা ও কালোর কোনো ভেদাভেদ নেই।
তাছাড়া সাবুদ ও আলামত (Clue)সহ PW (Prosecution Witness) এবং DW (Defence Witness) এর উপর ভিত্তি করে বস্তুনিষ্ঠ জেরাকরণ (Crossing) এবং সর্বোপরি যে রায় দেয়া হয়, তার বাইরে কোনো আইনজীবী ও বিচারকের যাওয়ার ক্ষমতা নেই। এ ক্ষেত্রে বিশাল ক্ষমতা ও জ্ঞানের অধিকারী হলেও কোনো ব্যক্তিগত মতামত প্রয়োগ বা চাপিয়ে দেয়ার এতটুকু অবকাশ নেই। আইনের দর্শনের আওতায় সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যেই সাদা লাঠি নিয়ে ভেবে-চিন্তে এগোতে হয়। কেন এর গুরুত্ব এত বেশি যে, সে ব্যাপারে কথিত আছে তত্কালীন কাজীর এজলাসে অন্যান্য সাধারণ প্রজাদের মত স্বয়ং বাদশাহ নামদার ফরিয়াদী বা আসামি হিসেবে বিবেচিত, তার বাইরে নয়। সংক্ষেপে এ কথাটি দাঁড়ায় আইনজীবী মামলার মেরিটের উপর ভিত্তি করে সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে গ্রহণযোগ্য যুক্তিতর্ক সম্বলিত বক্তব্য রাখবেন। এর মধ্যে আইনের ধারা, উপ-ধারা, বিধি, প্রবিধি, নজির (Precedent) ইত্যাদি টেনে আনতে পারেন। তেমনি বিজ্ঞ বিচারকও সর্বদিকে বিবেচনা করে অন্যদিকে না তাকিয়ে বা আইনের স্বচ্ছতার রূপ পরিগ্রহ করে কালো তথা অন্ধত্বের প্রেক্ষাপটে সুবিবেচক ও বস্তুনিষ্ঠ রায় দিয়ে থাকেন।
দ্বিতীয়ত: এদিকে বিকল্প তত্ত্ব নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করলে এ মর্মে উপনীত হই যে, কালো কোট বা গাউনের অর্থ নিজের পরিচয় গোপন রাখা। তাছাড়া কালো কোট বা গাউনের মধ্যে গলায় সাদা বো/টাই বা ব্যান্ড ব্যবহারের প্রধান হেতু হল তিমিরাচ্ছন্ন ঘোর অন্ধকার থেকে সাদা তথা আসল সত্যকে খুঁজে বের করা। ইতোপূর্বে বাংলাদেশসহ বৃটিশ কলোনিগুলোতে বেঞ্চের পরিধানকৃত কালো কোট বা গাউনের হাতা তার হাতের চেয়ে লম্বা রাখার রেওয়াজ ছিল। অবশ্য এখন আর সে রীতির প্রচলন নেই। তবে যুক্তরাজ্যে এ বিধি এখনো মেনে চলা হচ্ছে। যাহোক, লম্বা হাতার ব্যাখ্যা হলো আইনের হাত এত দীর্ঘ যে আসামি এ অবনীর যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, এ হাত আইনসম্মত রাডারের মত হাজির হয়ে তাকে খুঁজে বের করবেই। এতদ্ব্যতীত অপরাধী যত জ্ঞানী বা ক্ষমতার অধিকারী হোক না কেন, আইনের হাত লম্বা বিধায় সংশ্লিষ্ট সাজাপ্রাপ্ত আসামি বেঞ্চের রায় মানতে বাধ্য। এদিকে বিচারকের সাদা লম্বা পরচুলা (Wig) সম্পর্কে না বললে কিছুটা কমতি থেকে যায়। তাই সুপ্রিয় পাঠকের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে, আমাদের দেশে এ রেওয়াজ ইতোমধ্যে উঠে গিয়েছে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি এখনও পরচুলা পরে থাকেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বিচারকের পরচুলা পরিধান ব্যতিরেকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে এখনো কোনো বিচার কাজ সম্পন্ন হয় না। তারা অদ্যাবধি এর গুরুত্ব এবং নিগুঢ় দর্শন আঁঁকড়ে ধরে আছেন। উল্লেখ্য, সাদা পরচুলার পিছনের রহস্য হলো সাদা কেশি বৃদ্ধ মা জননী সন্তানের প্রতি যেমন স্নেহপরায়ণ থাকেন, তার কাছে সকল সন্তান একই ধরনের এবং সমান। কারো প্রতি অবিচার করার মানসিকতা থাকে না। সে আলোকে দু’পক্ষই (বাদী ও বিবাদী) তার সন্তান বলে বিবেচ্য বিধায় সঠিক বিচারের পথ সমুন্নত থাকে, কোনো পক্ষপাতিত্বের অবকাশ থাকে না। এজলাসে দু’পক্ষের কথা ও আবেদন মায়ের মত আন্তরিকভাবে শুনে ঠাণ্ডা মাথায় রায় (Verdict) দিয়ে থাকেন। যাতে বিবাদী আত্মপক্ষ সমর্থনের (Self Defence) মৌলিক অধিকার (Fundamental Right) ও ন্যায়পরায়ণতা (Equity) বরখেলাপের এতটুকু সুযোগ না থাকে। ফলশ্রুতিতে সংশ্লিষ্ট সবার সু-বিচার পাওয়ার পথ সুগম হয়।
More আইনজীবী ও মোয়াক্কেলঃ কিছু কার্য্যকরী পরামর্শ মোয়াক্কেলদের উদ্দেশ্যে কিছু পরামর্শ